প্রতিক্ষণ ডেস্ক:
উপমহাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তিনি । তার নির্মিত চলচ্চিত্রের অন্যতম উপাদান ছিল আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ, আত্মপরিচয় অন্বেষা, জাতিসত্তা, রাষ্ট্র ও সমাজ।
প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে নিজেকে দক্ষ নির্মাতা হিসেবে তৈরি করেছেন তিনি। মুক্তির গান এবং মুক্তির কথা নির্মাণের মধ্য দিয়ে যে শিক্ষাটা তিনি পেয়েছেন, বিশেষ করে দার্শনিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে—সেসবের একটা বহিঃপ্রকাশ ঘটে তারেক মাসুদের পরবর্তীকালের চলচ্চিত্রগুলোতে।
‘মুক্তির গান’ নির্মাণের নেপথ্য গল্প নিয়ে তারেক মাসুদ নির্মাণ করেন ‘মুক্তির কথা’ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র।‘ মুক্তির গান’-এ শরণার্থী শিবির, মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাফেরা, সংস্কৃতিকর্মীদের গান এগুলো এসেছে। মুক্তির গান দেখানোর পর মানুষের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া, সেগুলো মুক্তির কথায় এসেছে। মুক্তির গান-এ যাঁরা শরণার্থী শিবির এবং মুক্তাঞ্চলে ছিলেন, তাঁদের কথা এসেছে। মুক্তির কথায় মানুষ অসহায় অবস্থা থেকে প্রতিরোধকারী যোদ্ধায় কীভাবে পরিণত হয়েছিল, সে বিষয়গুলো এসেছে।
২০০২ সালে নির্মাণ করেন প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘মাটির ময়না’। মুক্তিযুদ্ধ আশ্রিত নান্দনিক এই সিনেমা কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হওয়ার পাশাপাশি জিতে নেয় সমালোচক পুরস্কার। এছাড়া প্রথম বাংলাদেশি সিনেমা হিসাবে অস্কার প্রতিযোগিতায় বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ২০০৪ সালে ছবিটি ব্রিটেনের ডিরেক্টরস গিল্ড পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র হিসেবে অংশ নেয় মাটির ময়না।
এ ছবিটির মধ্য দিয়েই ইউরোপে প্রথম বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক প্রদর্শনী শুরু হয়। মূলত মাটির ময়নায় তারেক মাসুদ নিজেরই জীবনের গল্প বলেছেন। তাঁর মাদ্রাসার জীবন, পরিবার এবং মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছেন সেলুলয়েডের ফ্রেমে। এ ছবিটির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরেন তারেক মাসুদ। তুলে ধরেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে।
‘নরসুন্দর ‘ তার একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ দুজন মিলে ২০০৮ সালে এটি নির্মাণ করেছেন। তারেক নরসুন্দর নির্মাণ করেছেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরী মুভমেন্টস রিসার্চ তথা ‘রামরু’ নামক একটা সংস্থার অর্থে, যারা অভিবাসী-আটকে পড়া উদ্বাস্তু মানুষ প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে কাজ করে। তারেক মাসুদের বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত একটা পলিটিক্যাল থ্রিলার নরসুন্দর।
নরসুন্দর-এর গল্পে দেখা যায় যে মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁর মা-বাবাকে দেখতে আসেন, আর্মি খবর পেয়ে যায়, তাঁকে ধরতে এলে তিনি পালিয়ে যান। তাঁকে না পেয়ে তাঁর মা-বাবাকে অত্যাচার করে সেনারা। তিনি পালিয়ে গিয়ে ওঠেন এক সেলুনে। সেলুনে ওঠার সময় বিহারিরা দেখে তাঁর দাড়িটাড়ি হয়ে গেছে, তিনি খুব ভীতসন্ত্রস্ত, তাড়া খাওয়া খরগোশের মতো কাঁপছেন। ছেলেটি দাড়ি কামাতে বসে পড়ে। বিহারি সেলুনের মালিক, নাপিত তারা বুঝে ফেলে যে ছেলেটি মুক্তিযোদ্ধাই হবে। কিন্তু তারা সেলুনে আর্মি এলেও ছেলেটিকে ধরিয়ে দেয় না।
এ ছবির প্রতিটি সিকোয়েন্সে টান টান উত্তেজনা। সমকালীন বাংলা চলচ্চিত্রে এ ধরনের থ্রিলার কেউ দেখাতে পারেনি বলে মনে করে চলচ্ত্রি সংশ্লিষ্টরা।
১৯৫৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানায় তারেক মাসুদের জন্ম। শৈশবে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ভাঙ্গা ঈদগাঁহ মাদ্রাসায়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন। ১৯৮৯ সালে বিয়ে করেন মার্কিন নাগরিক ক্যাথরিন মাসুদকে। তাঁদের একমাত্র সন্তান মাসুদ নিষাদ।
এই গুনী নির্মাতা এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় নিতহ হয়েছেন। বেঁচে থাকলে মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে তৈরি হতো আরো কিছু জীবন ঘনিষ্ঠ ছবি। চলচ্চিত্ত্র বোদ্ধাদের মতে, চাষী নজরুল, খান আতাউর রহমানের পর তারেক মাসুদের মতো এ ধরনের জীবনঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা খুব কমই পেয়েছে বাংলাদেশ। তার ছবিতে ভর করে বাংলার মানুষের মুক্তির ইতিহাস পৌঁছে যায় বিশ্ব দরবারে।
প্রতিক্ষণ/এডি/রাকিব